About Us



ডাউন দা মেমোরি লেন - পাবেসাস এর জন্মকথা

পানভেল বেঙ্গলি সাংস্কৃতিক সংস্থা সংক্ষেপে পাবেসাস এর জন্মকথা, সমস্ত লেখা টি সত্য ঘটনাবলী অবলম্বনে এবং পূর্বসূরীদের কাছ থেকে শুনে লেখা। সুতরাং যদি কোনো ঘটনা ক্রমের ত্রুটি থাকে তা মার্জনীয়।


সে গত বিংশ শতাব্দীর নব্বই দশকের গোড়ার কথা। ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাই নগরী থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার পূর্বে সহ্যাদ্রি পর্বতমালার কোলে ছোট্ট এক শহর পানভেল। এই শহরে মারাঠা সাম্রাজ্যের কিছু নিদর্শন থাকার কারণে এই শহর ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। এহেন পাভেল শহরে ওএনজিসি তার কর্মচারীদের থাকার জন্য এক বিশাল আবাসন তৈরি করে, পানভেল ওএনজিসি কলোনি। ওএনজিসির চাকরি সূত্রে উড়ে আসা এক ঝাঁক বাঙালি এই পানভেল কলোনিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো। সামাজিক ভাবে মেলামেশা ছিল ঠিকই। তবে মুম্বাইয়ের অফশোরে বা অনশোরে প্রত্যেকের নিজস্ব ডিউটি প্যাটার্ন বজায় রেখে সামাজিক কোনো সৃজনশীল দায়বদ্ধতা স্বীকার করা একপ্রকার অসম্ভব ছিল। তবু কথায় বলে চারটি বাঙালি এক হলেই নাকি একটা সংঘ বা ক্লাব তৈরি করে ফেলে। তেমনভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল পানভেল বেঙ্গলি সাংস্কৃতিক সংস্থা। কিছু সৃষ্টিশীল দূরদর্শী বাঙালির উদ্যোগে পানভেল কলোনির ঘেরাটোপের মধ্যে এক টুকরো কলকাতা ঢুকে পড়ে । সেই উদ্যোগী মানুষগুলোর উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ধুপ-ধুনোর ধোঁয়া, ঢাকের বাদ্দ্যি, কাঁসর-ঘন্টার শব্দে আমাদের ফেলে আসা দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনা। যে দিনগুলোর প্রতিচ্ছবি তারা তুলে ধরতে চেয়েছিল আমাদের সন্তানদের কাছে, পরবর্তী প্রজেন্মের কাছে।


আমরা যদি পিছনে তাকাই, তাহলে হয়তো আমাদের মন কিছু দীর্ঘায়িত চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে যাবে। নস্টালজিক কিছু মুহূর্তের চিন্তা যা বর্তমানে সর্বদা আমাদের আশেপাশে বিরাজমান আর সম্বৎসর আমাদের হৃদয়কে আনন্দ এবং সিম্ফনিতে পূর্ণ করে রাখে । সম্ভবত এটি একটি রূপকথা নয় এমনকি ইতিহাসের বই থেকে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদ ও নয়।


এ হলো
দৃঢ়তার উত্তরাধিকার,
ধারাবাহিকতার গভীরতা,
অখন্ডতার দাগ,
সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী ধ্বজা,
আর সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের অঙ্গীকার।


পাবেসাস এর জন্মকথা ভাবতে বসে স্মৃতিগুলো আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল পানভেল ওএনজিসি কলোনি, শপিং কমপ্লেক্সের এক কোণে । বর্তমানে যেখানে পোস্ট অফিস, তখনকার সেই খোলামেলা শান-বাঁধানো চত্বরে। আশির দশকের শেষ লগ্নে কিছু জনহিতৈষী, উচ্চাভিলাষী, মহান দৃষ্টিভঙ্গি সমৃদ্ধ মানুষ বঙ্গ সংস্কৃতির ঐতিহ্যের চারা রোপণ করেন সেখানে। বাংলার সন ১৩৯৭, ইংরেজি সাল 1990, জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় ONGC কলোনির প্রায় 30- 35 জন বাঙালি, শ্রী চন্দ্র নাথ শী এর ব্যাচেলার ফ্ল্যাটে মিলিত হন। উদ্দেশ্য, দূর্গা পূজার আয়োজন এই কলোনিতে সম্ভব কিনা। কেননা এর আগের বছর অর্থাৎ 1989 তে কালীপূজা দিয়ে শুরু করে জানুয়ারি মাসে সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা হয় এই পোস্ট অফিস আর স্টেট ব্যাঙ্ক চত্বরে।


কমিটি গঠন

সর্বসম্মতিক্রমে দুর্গাপূজা সংঘটিত করার ইচ্ছা জাহির হলো। সর্বপ্রথম যেটা প্রয়োজন সেটার উপর সবার রায় ব্যক্ত করা হলো এবং প্রায় সত্তর হাজার টাকা বাজেট রাখা বা ধার্য করা হলো। প্রয়োজন হলে নিজেদের বোনাসের টাকাটা ও দান করার কথা হল। ব্যাপক হইচইয়ের মধ্যে সর্বসম্মতিক্রমে যে কমিটি গঠন হলো সেটা হল --


প্রেসিডেন্ট - শ্রী সুভাষ চন্দ্র বাসু, যিনি সেই বছরই বরোদা থেকে ট্রান্সফার হয়ে এসেছিলেন
ভাইস প্রেসিডেন্ট - শ্রী দেব নারায়ণ ঘোষ
সেক্রেটারি - শ্রী সলিল চট্টোপাধ্যায়
ট্রেজারার - শ্রী শিবতোষ দেব
পূজা - শ্রী শ্যামা প্রসাদ ব্যানার্জি
ভোগ - শ্রী রবি শংকর ঘোষ
কালচারাল - শ্রী রঙ্গনাথ মুখার্জি এবং শ্রী সমীর লস্কর
ডেকোরেশন - শ্রী গৌতম জানা এবং শ্রীমতি ঝর্ণা জানা
সুভেনিয়র - শ্রী অজয় বিশ্বাস যিনি পরে ASTO ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন
এবং অডিটর শ্রী স্বপন বাগ, কিছুদিন পরে স্বপনদার Vashi র কাছে Helibase এর বাসে প্রচন্ড এক্সিডেন্ট হয়। কোনক্রমে প্রাণে বেঁচে যান তিনি।


এই কমিটির এক্সেকিউটিভদের সাথে আরো যারা প্রধান ভূমিকায় কাজে নেমে পড়লেন তাঁরা হলেন-- শ্রী অলক মৈত্র শ্রী সৌভাগ্য দাস, শ্রী রাজদীপ দত্ত, শ্রী দেবাশীষ মজুমদার, শ্রী সুশান্ত চৌধুরী, ডাঃ পার্থ দাস, শ্রী গোপাল সাহা, শ্রী ত্রিবেণী বাগচী, শ্রী অনুপ দত্ত রায়, শ্রী অরূপ রতন দাস, শ্রী গুণময় কুন্ডু, শ্রী গৌতম জানা, শ্রী মুকুল বড়ুয়া, শ্রী সত্য রঞ্জন বিশ্বাস, শ্রী গোপাল চন্দ্র পাল, শ্রী পার্থপ্রতিম দাস, শ্রী চন্দ্র নাথ শী, শ্রী রণজিৎ কুমার দাস, শ্রী সমীরণ দেব রায়, শ্রী আশিষ রায়, শ্রী অঞ্জন বসু, শ্রী অভিজিৎ দত্ত,l শ্রী প্রলয় নন্দী, শ্রী দুলাল রায়, শ্রী সুমিত কুমার সান্যাল এবং আরো অনেকে যাদের উৎসাহ এবং উদ্দীপনার পরাকাষ্ঠায় এই পুজোটা আরম্ভ করা সম্ভব হয়েছিল অবশ্য মায়ের কৃপা ও সর্বোপরি।


দুর্গা মূর্তি

মায়ের মূর্তির খোঁজে থানে কাপুরবাউড়ি থেকে কোলাভার নেভি নগর পর্যন্ত তল্লাশি করা হলো। শেষ পর্যন্ত একটি আস্ত চটির শুকতলা খইয়ে, মালাকার স্বর্গীয় মাখন পাল যিনি বর্তমান মালাকার শ্রী দীপঙ্কর পাল এর পিতা, তাঁর হাতে সঁপে দেওয়া হল মূর্তি গড়ার ভার। দক্ষিণা সাকুল্যে আট হাজার টাকা। তারপর Mahakali caves Road, Andheri থেকে গাড়ি নিয়ে Nevi Nagar থেকে চতুর্থীর দিন ঠাকুর আনা অবশ্যই একটা অ্যাচিভমেন্ট , কেননা সকাল চারটের Helibase Bus এ বেরিয়ে সন্ধ্যের পরে পানভেল কলোনি পৌঁছানো একটা স্মরণীয় উপলব্ধি।


ভোগ

হন্যে হয়ে খুঁজে পাওয়া গেল মন্ডল বাবুকে, নিউ পানভেল এ তখন EIL Mess চালু ছিল। সেখানে পেশাদার রাঁধুনি তিনি। কিন্তু সবথেকে ঝটকা লাগলো তখন, যখন সব জিনিসপত্র ভাড়া করতে যাওয়া হল। শেষমেশ দেখা গেল হাঁড়ি কড়াই খুন্তির তিন চার দিনের ভাড়া নতুন কেনার সমতুল্য। তাই প্রথম বছরের উদ্বৃত্ত রাশি দিয়ে পরের বছর আগেভাগে রান্নার বাসন কিনে ফেলা হয়েছিল। আর তহবিল বাড়ানোর জন্য পানভেল এর দোকানে হোটেলে এবং ব্যাংকে গিয়ে পাওনাদারদের মতন তাগাদা দেওয়া একটা কৌতূহলের ব্যাপার। প্রসঙ্গত মনে পড়ে একবার পানভেল ওয়েলকাম হোটেলের সামনে চওড়া ড্রেন লাফ দিয়ে পার হতে গিয়ে শ্রী অলক মৈত্র ড্রেনের মধ্যে পড়ে যান। পায়ে চারখানা স্টিচ ব্যান্ডেজ সমেত পরের দিন আবার সুভেনিয়র কালেকশনে বেরিয়ে পড়েন। যাহোক পূজারী জোগাড় করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। পূজারী ঢাকি সমেত পূজার সরঞ্জাম কলকাতা থেকে আনানো হয়েছিল। পূজার বিশেষ ভোগ বানাতেন শ্রী ত্রিবেণী বাগচী এবং তার স্ত্রী স্বর্গত শ্রীমতি সোমা বাগচী। পরবর্তীকালে শ্রী তপন কুমার মন্ডল, শ্রী দিপাল কুমার ধর, শ্রী রতন দাস, শ্রী আসিতাভ জানা এবং আরো অনেকে ভোগ প্রসাদের দায়িত্ব নেন।


সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

এইখানেই বেশ বেগ পেতে হল । কেননা এই প্রথম পূজা উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। মহিলা মহল থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। পানভেল এ প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে কে যে কি করে তেমনভাবে কারো জানা ছিল না। "চান ঘরে গান" করা মানুষ দিয়ে তো আর ঝাঁ-চকচকে স্টেজে অনুষ্ঠান করানো যায় না! তার ওপর জুলাই-আগস্ট ভরা বর্ষা। ছুটির দিনে বিকেলে আড্ডার লোক পাওয়া বিরল। এরই মধ্যে একদিন কোনো এক B Type এর সামনে দেখা গেল পাঁচিলের ওপর কে বা কারা যেন তবলা বাঁয়া শুকাতে দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল কোনও এক শ্রী পবন কুমার দেব দাদা এই বছর ট্রান্সফারে এসেছেন। ওনার স্ত্রী শ্রীমতি শিল্পী দেব ভালো গান করেন। আশার আলো জাগলো। এরপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ধামাকা করার জন্য ভোজপুরি ফিল্মের মিউজিক ডাইরেক্টর দিলীপ দত্তর Orchestra আনানোর ব্যবস্থা হয়। উনি তৎকালীন বিখ্যাত গায়িকা চন্দ্রানী মুখার্জী কে উপস্থাপন করবেন কথা ছিল। কিন্তু মাত্র দু হাজার টাকার জন্য তা সম্ভব হয়নি। অন্য আরেক প্রচেষ্টায় কুমার শানু চেয়ে বসলেন 5000 টাকা। যা কিনা কমিটির সাধ্যের বাইরে ছিল। এরপর অনুষ্ঠান উদ্বোধনের জন্য বাংলা হিন্দি ছবির প্রখ্যাত নায়ক প্রদীপ কুমার কে আনার পুরো আয়োজনটাই ভেস্তে গেল। কেননা অনুষ্ঠানের দিন অর্থাৎ নবমীর রাতে প্রচন্ড বর্ষণে চতুর্দিক জল থৈ থৈ। হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে মায়ের আরতি হল। অনুষ্ঠান আর হল কই! পরে অবশ্য অনুষ্ঠান হল কালীপুজোর রাতে। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার 1990 সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত দিলীপ দত্ত এবং তার দলকে আনা হয়েছিল। পরের বছর জনপ্রিয় অর্কেস্ট্রা "কলাকার" 5000 টাকায় আনা হয়েছিল। পুজোর সময় মোট তিন দিনের অনুষ্ঠানে একদিন বাইরের আর্টিস্ট আর বাকি দুদিন ঘরোয়া প্রোগ্রাম হত। রিয়ার্সাল এ ছোট-বড় বাচ্চাদের উৎসাহ দেখার মত ছিল। পানভেল বাজারের মির্চি গলির পাশে টপাল নাকা থেকে রাজা রানী রাক্ষস সেনাপতি খরগোশ ইত্যাদি ফ্যান্সি পোশাক ভাড়া করে এনে নাটক করানো হতো।


মা লক্ষীর ঘট

প্রথম বছর সত্তর হাজার টাকা বাজেট এর লক্ষ্যে তহবিলে শেষ পর্যন্ত জমা পড়ল প্রায় 1 লাখ 20 হাজার। জয় মা! জমা অতিরিক্ত রাশি দিয়ে কিছু কিছু জিনিস কিনে ফেলা হলো এবং ভারত সেবাশ্রম সংঘের সমাজসেবাতে দানের ব্যবস্থাও করা হলো। পানভেল এবং তার আশেপাশের বাণিজ্যিক সংস্থা গুলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিল বলে প্রথম বছরের পুজো সফলভাবে সংঘটিত হলো। এখানে উল্লেখনীয় যে পানভেল Shivaji Chowk এ Kings electronics এর তখন একটাই দোকান ছিল আর তার মালিক প্রকাশ ভাই এর যোগদান অনস্বীকার্য। প্রথম বছর থেকেই ওনারা Cultural Programme এর Co-sponsor হন এবং 6000- 8000 টাকা donation করতেন।


1990 তে পানভেল বেঙ্গলি সাংস্কৃতিক সংস্থার প্রথম পুজোটা যে ভালোভাবে সুসম্পন্ন হবে কিনা সে নিয়ে অনেকেই চিন্তিত ছিলেন কিন্তু মায়ের কৃপায় প্রথম বছর পুজো নির্বিঘ্নে হয়ে যাওয়াতে মনোবল বেড়ে গেল। ইতিহাস বলে যে, প্রথম দুর্গাপূজার চারদিন আম্বেদকর ভবনে ঢোকার মুখে নহবত বসানো হয়েছিল। সানাইয়ের মূর্ছনায় প্রবাসী বাঙালি আহ্লাদে আটখানা হয়েছিল। পরের বছরের পুজোতে আরো মানুষ উৎসাহ এবং উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে আসেন। তবে Core Group এ 10 - 12 জনই বরাবর থাকতেন। এর চেয়ে বেশি লোকের সহযোগিতা পাওয়া মুশকিল ছিল। কিন্তু পুজোয় আনন্দ তো সবার। পরের বছর ট্রান্সফার এ এসে এই পুজোর সাথে আরো যাঁরা যোগ দিলেন তাঁরা হলেন, ডঃ শংকর সেন, শ্রীমতি পিন্টু সেন, শ্রী দেবাশীষ প্রামাণিক, শ্রী জয়তোষ সরকার, শ্রী বাসুদেব সরকার, শ্রী সুজিত গুহ রায়, শ্রী তাপস সেনগুপ্ত, শ্রী সুভাষ পুরকায়স্থ, শ্রী শান্তনু সাহা এবং আরো অনেকে।


শ্রী অরূপ দাস, শ্রী মলয় মুখার্জি, শ্রীমতী সবিতা (জলি) মুখার্জি, শ্রী সুপ্রতীক ব্যানার্জি, শ্রীমতী রুপা ব্যানার্জি, শ্রীমতি সুমিত্রা(মিনি) চৌধুরী এনাদের অদম্য উৎসাহে "ঝংকার" অর্কেস্ট্রা দল তৈরি হলো। অন্যদিকে স্বর্গীয় শ্রী রঙ্গনাথ মুখার্জি, শ্রী ত্রিবেণী বাগচী এবং আরো অনেকে মিলে নাটকের দল গঠন করলেন। প্রথম দু'বছর স্ত্রী বর্জিত নাটক হয়েছিল। পরে শ্রী আশিস সাহা এবং শ্রীমতী পারমিতা (সোমা) সাহা যোগ দিলেন, অত্যন্ত সাফল্যের সাথে মঞ্চস্থ হলো নাটক "প্রভাত ফিরে এসো"। উল্লেখ্য যে, এই নাট্য গ্রুপের উপস্থাপনা মুম্বাইয়ের দাদারে পুরস্কৃত হয়েছিল। আর ঝংকার অর্কেস্ট্রা দল পানভেল শহর এবং তার আশেপাশে অনুষ্ঠান করা আমন্ত্রণ পেত।


কিছু স্মৃতি

সংসার বাঁধার পর যে পিঁড়িতে বসে ভাত খাওয়া হতো বা যে তোয়ালে দিয়ে মুড়ে সদ্যোজাত সন্তানকে হসপিটাল থেকে ঘরে আনা হয়েছিল সেই সুমধুর স্মৃতিখন্ড হঠাৎ নজরে এলে মনে আলোড়ন খেলে যায়। কত সুখ দুঃখ ভিড় করে আসে মনের আঙিনায়। তেমনই কিছু স্মৃতি বিজড়িত ছবির মাধ্যমে খানিক নস্টালজিক হওয়া যাক।


প্রথম কালীপূজা

 Bengali Kali Puja Mumbai

ONGC পানভেল কলোনির শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণ কার্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পোস্ট অফিস ব্যাংক বা অন্যান্য দোকানের লিজ তখনো দেওয়া হয়নি। এমত পরিস্থিতিতে বর্তমান পোস্ট অফিসের collapsible Gate দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে এখন যেখানে letter sorting করার জন্য টেবিল রাখা আছে সেই স্থানে দুই জানালার মাঝখানে 1989 এ প্রথম কালীপূজা সংঘটিত হয়। প্রেসিডেন্ট ছিলেন শ্রী দেব নারায়ণ ঘোষ। শ্রী গৌতম জানা এবং ওনার স্ত্রী শ্রীমতী ঝর্ণা জানা ডেকোরেশন করেছিলেন। পুরনো সদস্যরা হয়তো স্মৃতিচারণ করলে মনে পড়বে যে এই দেওয়ালের পিছনে গণেশের পান-বিড়ির দোকান ছিল। এরপর 1990 সালে সরস্বতী পুজো হয়েছিল স্টেট ব্যাংক চত্বরে আর প্রথম দুর্গাপুজো হয়েছিল নবনির্মিত আম্বেদকর ভবনে।


আম্বেদকর ভবনে প্রথম সরস্বতী পূজা

 Bengali Saraswati Puja Mumbai  Bengali Saraswati Puja Mumbai

 Bengali Saraswati Puja Mumbai

1991 সালের 20 শে জানুয়ারি শ্রীশ্রী বাগদেবীর আরাধনার মাধ্যমে নবনির্মিত আম্বেদকর ভবনে এই সংস্থার সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ক্রিয়া কর্মের সূচনা হয়। পূজা মণ্ডপে হাতে খড়ি অনুষ্ঠানে কচিকাঁচাদের ভিড়। প্রথম সরস্বতী পূজা অবশ্য 1990 তে শপিং কমপ্লেক্সের স্টেট ব্যাংক চত্বরে হয়। জাবদা খাতার ধুলো ঝেড়ে পাওয়া গেল একটা তথ্য, এক ড্রাম খিচুড়ি নাকি দুদিন পরেও গরম ছিল। তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন শ্রী বাসুদেব সরকার।


সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

 Bengali Cultural Program Mumbai

আম্বেদকর ভবনের প্রবেশ চত্বরে পানভেল বেঙ্গলি সাংস্কৃতিক সংস্থার সার্বজনীক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দৃশ্য ছবিতে দেখা যাচ্ছে। আম্বেদকর ভবনের ভিতরে শব্দ প্রতিধ্বনি হওয়ার কারণে সমগ্র অনুষ্ঠানটি বাইরে মঞ্চস্থ করা হয়। উদ্বোধনী সংগীত এবং বক্তৃতার পর স্বর্গীয় শ্রী শুভব্রত মিত্র ধরলেন ববি সিনেমার নরেন্দ্র চঞ্চল এর এক বিখ্যাত গান। উদারা মুদারার সীমানা ছাড়িয়ে তারা সপ্তকের ধৈবত স্বর দিয়ে শুরু সেই গান "বেশক মন্দির মসজিদ তোড়ে, বুল্লেশা ইয়ে কহতা..."। পানভেল কলোনির সমস্ত জনতার করতালিতে অনুষ্ঠান তেতে উঠলো। এরপর এক এক করে শ্রী অরূপ দাস, শ্রীমতী মিত্রা গুহ রায়, শ্রী মলয় মুখার্জি, শ্রীমতী মিনি চৌধুরী তাঁদের সুর ঝংকারে আসর জমিয়ে দিলেন। সবশেষে স্টেজে এলেন শ্রীমতি শিল্পী দেব, হুবহু লতা মঙ্গেসকারের কণ্ঠস্বরে গাইলেন সত্যম শিবম সুন্দরম ছায়াছবির সেই আলোড়ন সৃষ্টিকারী গান। " ঈশ্বর সত্য হ্যায়, সত্য হি শিব হ্যায়, শিব হি সুন্দর হ্যায়.."। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে আশাবরী ঠাটের দরবারী কানাড়া রাগ জাদু করে গেল। ফেব্রুয়ারির বিদায়ী শীতের সান্ধ্য আমেজে এক নতুন যুগের সৃষ্টি হলো।


 Bengali Cultural Program Mumbai

পানভেল বেঙ্গলি সংস্কৃতিক সংস্থার প্রথম সার্বজনীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের এক দৃশ্য । মুম্বাইয়ের পারেল থিয়েটারের সাউন্ড সিস্টেম উইথ মিক্সার সাড়ে তিন হাজার টাকায় ভাড়া করে হেলি-বেস বাসে চড়িয়ে নিয়ে আসা হল। শ্রী সনৎ চৌধুরী সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার এর দায়িত্ব নিলেন। ড্রাম আর ঢোলক বাজানোর জন্য দুজনকে ভাড়া করে আনা হলো। বাকি যন্ত্রীরা যারা স্টেজ কাঁপালেন তারা হলেন তবলায় শ্রী গোপাল চন্দ্র পাল, গিটারে শ্রী ব্রহ্ম দেব শর্মা এবং শ্রী শান্তনু সেন, কিবোর্ডে শ্রী মলয় মুখার্জি, শ্রী সুপ্রতীক ব্যানার্জি এবং শ্রীমতী রুপা ব্যানার্জি এবং আরো অনেকে।


 Bengali Cultural Program Mumbai
তবলা সঙ্গতে শ্রী গোপাল চন্দ্র পাল

 Bengali Cultural Program Mumbai
মাটিতে পাত পেড়ে বসে মায়ের প্রসাদ খাওয়ার স্মৃতি আজও জ্বলজ্বলে

 Bengali Cultural Program Mumbai
পানভেল বেঙ্গলি সাংস্কৃতিক সংস্থা কে যারা তিল তিল করে গড়ে ছিল তাদের একাংশ

 Bengali Cultural Program Mumbai

কোনও এক কলেজ চত্বরে কালাদার চায়ের দোকান। সারাদিন ধরে সেই চায়ের দোকানে ছাত্র-ছাত্রীদের আনাগোনা। তাদের চা বিস্কুট পরিবেশনের মাঝেই কালাদা তাদের সুখ দুঃখের খবর পেতেন। কোন স্যার ভালো পড়ান, কোন ছাত্র দারিদ্র্যের চরম সীমায় থেকেও প্রথম স্থান নেয়, কোন দুজন লাস্ট ক্লাস পালিয়ে অনাদির রেস্টুরেন্টে ভেজিটেবিল চপ খেতে খেতে প্রেম করেছিল ইত্যাদি সব খবরই কালাদার কানে আসে। ছবিতে কালাদার ভূমিকায় শ্রী দিলীপ চক্রবর্তী কে দেখা যাচ্ছে।


 Bengali Cultural Program Mumbai
পানভেল কলোনীর সেন্ট্রাল স্কুলের মাঠে মেগা কালচারাল নাইট

প্রবাসে মানুষ খুঁজে বেড়ায় নিজের ভাষার মানুষকে। প্রবাসী মন প্রশ্ন করে, "আমি কোথায় পাব তারে,আমার মনের মানুষ যে রে"। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তার উত্তর মেলে - "আমার প্রানের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তাই সকল খানে"। শুধু প্রবাসী মন নয়, মানুষের মনের এই অন্বেষণ এবং উপলব্ধির উপরেই দাঁড়িয়ে পানভেল এর বঙ্গীয় সমাজ পরিবার। এই উপলব্ধিকে বুকে বেঁধে নতুন পুরোনো সদস্যদের আসা-যাওয়া প্রবহমান, যা কিনা আমাদের পরিবারের বাঁধনকে শক্ত করে রাখে। বঙ্গীয় ঐতিহ্য সংস্কৃতি ভাষা পোশাক খাদ্য এবং সর্বোপরি শিষ্টাচার এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের বলিষ্ঠ কাঁধে উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হয় । পাবেসাসের বঙ্গ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী ধ্বজা সুদূর আসাম শিলচর আগরতলা কলকাতা বরোদা আমেদাবাদ দেরাদুন দিল্লি রাজামুন্দ্রি চেন্নাই এমনকি ভারতের বাইরে বিদেশেও দৃশ্যমান।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার

তথ্য এবং ছবি দিয়ে যারা সাহায্য করেছেন শ্রী সুভাষ চন্দ্র বাসু
শ্রী সলিল চট্টোপাধ্যায়
শ্রী গোপাল চন্দ্র পাল
শ্রী বাসুদেব সরকার
শ্রী সনৎ চৌধুরী
এবং
স্বর্গীয় শ্রী রঙ্গনাথ মুখার্জী

সমগ্র লেখাটি লিপিবদ্ধ করেছেন
শ্রী সমর কুমার দাস